বঞ্চিতদের সঙ্গে পদোন্নতি পেলেন দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা

বঞ্চিতদের সঙ্গে পদোন্নতি পেলেন দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা

  • দুই সপ্তাহে ৩৪০ কর্মকর্তা পদোন্নতি পেয়েছেন।
  • অন্তত অর্ধশত বিতর্কিত ও দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাও পদোন্নতি বাগিয়েছেন

আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বঞ্চিত প্রশাসনের কর্মকর্তারা পটপরিবর্তনের পর পদোন্নতি পাচ্ছেন। কিন্তু অভিযোগ উঠেছে, বঞ্চিত এই কর্মকর্তাদের সঙ্গে মিশে পদোন্নতি বাগাচ্ছেন বিগত সরকারের আমলে বিতর্কিত ও দুর্নীতির অভিযোগ ওঠা বেশ কিছু কর্মকর্তাও। সব মিলিয়ে এমন অন্তত অর্ধশত কর্মকর্তা পদোন্নতি বাগিয়েছেন। তাঁদের বিরুদ্ধে দুদকের এবং বিভাগীয় মামলা আছে বা ছিল। তাঁদের মধ্যে অনেকে আবার জেলা প্রশাসক (ডিসি) হতে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এভাবে বিতর্কিতরাও পদোন্নতি পাওয়ায় প্রশাসনে সমালোচনা চলছে।

শুধু রাজনৈতিক কারণে আওয়ামী লীগের ১৬ বছরের শাসনামলে প্রশাসনে পদোন্নতিবঞ্চিত হয়েছেন কয়েক শ কর্মকর্তা। গোয়েন্দা তদন্ত প্রতিবেদনে তাঁদের নামের সঙ্গে ‘নেগেটিভ’ উল্লেখ থাকায় বঞ্চিত করা হয়। অনেককে বছরের পর বছর ওএসডি থাকতে হয়েছে, কিংবা গুরুত্বহীন পদে ফেলে রাখা হয়েছে। অনেককে বাধ্যতামূলক অবসরেও পাঠানো হয়েছে।

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর প্রশাসনের বঞ্চিত কর্মকর্তাদের পদোন্নতির দাবি ওঠে। দাবি আমলে নিয়ে ১৩ আগস্ট বিভিন্ন ব্যাচের ১১৭ জন সিনিয়র সহকারী সচিবকে উপসচিব পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়। এরপর ১৮ আগস্ট যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতি দেওয়া হয় ২০১ জনকে। তাঁদের মধ্যে অন্তত ৪৫ জন ১৩ আগস্ট উপসচিব পদে পদোন্নতি পেয়েছিলেন।

আরও ২২ কর্মকর্তাকে উপসচিব থেকে যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়। সব মিলিয়ে গত দুই সপ্তাহে ৩৪০ কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে।

পদোন্নতির প্রজ্ঞাপন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, বিসিএস ১৫তম ব্যাচের এ এস এম হুমায়ুন কবীর মঙ্গলবার যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতি পেয়েছেন। অথচ এই কর্মকর্তা শেখ হাসিনা সরকারের পতনের আগপর্যন্ত গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরীর একান্ত সচিব (পিএস) ছিলেন। মাসখানেক আগে উত্তরা-৩ প্রকল্প থেকে প্রধানমন্ত্রীর কোটায় পাঁচ কাঠার একটি প্লট বাগিয়েছেন তিনি, যার বাজারমূল্য ৭ থেকে ৮ কোটি টাকা।

একই কায়দায় ১৩ আগস্ট দুদকের মামলার আসামি ২৪ ব্যাচের কর্মকর্তা মুমিতুর রহমানও উপসচিব পদে জ্যেষ্ঠতাসহ ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি পেয়েছেন। অথচ তিনি গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা শাখায় থাকাকালে বহুল আলোচিত জি কে শামীম-কাণ্ডের মামলার আসামি।

বিসিএস ২৪তম ব্যাচের কর্মকর্তা রাসেল মনজুর বর্তমানে বাংলাদেশ কর্মচারী কল্যাণ বোর্ডের উপপরিচালক পদে আছেন। তিনিও উপসচিব হিসেবে পদোন্নতি পেয়েছেন বঞ্চিতদের তালিকায়। অথচ তিনি দিনাজপুরের বীরগঞ্জের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) থাকাকালে তাঁর গাড়িতে মাদক পাওয়া যায়। ২০১৫ সালে মাদকসংশ্লিষ্টতায় ইউএনও রাসেল মনজুরকে জড়িয়ে উপজেলা চেয়ারম্যান মো. আমিনুল ইসলাম মামলা করেন।

বিসিএস ২৪তম ব্যাচের কর্মকর্তা মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম পদোন্নতি পেয়ে উপসচিব হয়েছেন। ব্যাচের মেধা তালিকায় চতুর্থ হওয়া এই কর্মকর্তা চাকরির প্রথম দিকে ঢাকা জেলার কোতোয়ালি থানার এসি ল্যান্ড ছিলেন। সে সময়ে আর্থিক দুর্নীতির কারণে বিভাগীয় মামলা হয়েছিল তাঁর বিরুদ্ধে। কয়েক বছর আগেই তা নিষ্পত্তি হয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি। নজরুল বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকারের আশীর্বাদপুষ্ট কর্মকর্তা মহিবুল হক তখন ঢাকার ডিসি ছিলেন। বিএনপি ঘরানার কর্মকর্তা হওয়ায় আমার বিরুদ্ধে ডিপি চালু করেন।’

একই ব্যাচের কর্মকর্তা বাদল চন্দ্র হালদার বর্তমানে ঠাকুরগাঁওয়ের জেলা পরিষদের নির্বাহী কর্মকর্তা। তিনিও উপসচিব পদে পদোন্নতি পেয়েছেন। তাঁর বিরুদ্ধে আর্থিক দুর্নীতির মামলা আছে বলে অভিযোগ রয়েছে। তবে তিনি তা অস্বীকার করে বলেছেন, সবই মিথ্যা। তাঁর নাম সম্ভাব্য ডিসি ফিটলিস্টেও রয়েছে।

বিসিএস ২৫তম ব্যাচের কর্মকর্তা মোস্তাফিজুর রহমান পদোন্নতি পেয়ে উপসচিব হয়েছেন। ভোলা পৌরসভায় থাকতে দুর্নীতির ৫৫ লাখ টাকা তাঁর স্ত্রী ও শাশুড়ির ব্যাংক হিসাবে পাওয়া গিয়েছিল বলে অভিযোগ আছে। দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা হিসেবে প্রশাসনে পরিচিতি আছে ২৪তম ব্যাচের পদোন্নতি পাওয়া অতুল মণ্ডলেরও। এই ব্যাচের পদোন্নতি পাওয়া টিটন খীসা ও সাইফুল ইসলামের বিরুদ্ধেও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। তাঁদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলাও আছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র বলেছে।

২৫তম ব্যাচের হাসান হাবিব পদোন্নতি পেয়ে উপসচিব হয়েছেন। তিনি নীলফামারীর জলঢাকার ইউএনও থাকাকালে আর্থিক দুর্নীতির কারণে বিভাগীয় মামলা হয়েছিল। সেখানে ‘একটি বাড়ি একটি খামার’ প্রকল্পের একটি সমিতির ব্যবস্থাপককে লাঞ্ছিত করার অভিযোগও রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে।

এ ছাড়া ২৯তম বিসিএসের ৩১ কর্মকর্তার নিয়োগ অবৈধ ঘোষণা করেছিলেন হাইকোর্ট। এর মধ্যে প্রশাসন ক্যাডারের ১১ জন। তাঁদের একজন আসমাউল হোসনা লিজা এবার পদোন্নতি পেয়ে উপসচিব হয়েছেন। একই ব্যাচের সানজিদা ইয়াছমিনেরও পদোন্নতি হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে মাদারীপুরের এলএ শাখায় থাকাকালীন পদ্মা সেতুর রেল-সংযোগের ভূমি অধিগ্রহণের ২৯ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে দুদকে মামলা আছে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে প্রশাসন বিশেষজ্ঞ ও প্রশাসনসংক্রান্ত বহু গ্রন্থপ্রণেতা মো. ফিরোজ মিয়া বলেন, ‘যাঁরা যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও শুধু রাজনৈতিক কারণে বঞ্চিত হয়েছিলেন, শুধু তাঁদেরই পদোন্নতি দেওয়া উচিত। মেধাভিত্তিক প্রশাসন গড়তে চাইলে অবশ্যই পদোন্নতি দিতে হবে যাচাই-বাছাই করে। যাঁদের যোগ্যতা নাই, যাঁদের বিরুদ্ধে মামলা আছে, তাঁরা কেন পদোন্নতি পাবেন? বৈষম্য দূর করতে গিয়ে আরেক বৈষম্য যেন সৃষ্টি না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *