“নৈঋত”লেখক মোঃ ওবায়দুর রহমান ।।

হারুন শেখ স্টাফ রিপোর্টার বাগেরহাট জেলা।।

ঘোড়া দেখলে খোড়া হই আমি, খাট দেখলেই শুয়ে পড়ি৷ শুই-ঘুমাই, আরো কতকিছু করি…
বাড়িতে গেলে আমি যে রুমটাতে ঘুমাই, সেটা উত্তর-দক্ষিণমূখী৷ উত্তর দিকে মাথা রেখে দক্ষিণের জানালা দিয়ে আকাশ দেখি৷ ভোর বিহানে বাম দিকের পূর্বমুখী জানালার পর্দা গলিয়ে নবজাতক সুর্যের ভার্জিন আলো এসে চোখে-মুখে পড়ে৷ আমরা ৪তলায় থাকি৷ আমার শোবার ঘরটা দক্ষিণ-পূর্ব অর্থাৎ অগ্নিকোণে অবস্থিত প্রান্তসীমার একটি রুম৷ বাসার আশপাশ দিয়ে বিভিন্ন প্রজাতির অনেকগুলি পুরাতন দিনের গাছ রয়েছে৷ সারাদিন শহরময় ইতি-উতি ঘুরে বেড়ানো হরেক রকমের পাখিদের সন্ধ্যে হলেই; নীড়ে ফেরার আস্তানা এটা৷ পাখিরা নিয়ম মেনে চলে৷ হাই আলাস সালাহ্ শুনে আড়মোড়া ভেঙে জেগে ওঠে। সকলে মিলে সমস্বরে সুপ্রভাতের কুজন করে৷ পাখিদের কোনো জাত-পাত নেই৷ জাতি-বর্ণ, সুরে-বেসুরে একসাথেই তারা তেতুল পাতায় ন’জন হয়ে সুজনের মতই দলবব্ধ থাকে৷ ওদের সাথে আমিও উঠি৷ নামাজ আদায় করে আবার শুয়ে পড়ি৷ পূর্বমূখী জানালার কার্নিশ ঘেষে একটু তীর্যকভাবে তাকালেই; অগ্নিকোণে প্রাচীন একটি চম্বল গাছ দেখা যায়৷ গাছটির শাখা ও শিখরে সাফ বা সামিটের মত আঞ্চলিক দেশসমূহের একযোগে উড়তে থাকা পতাকার ন্যায় শহরের বিভিন্ন জায়গা থেকে ঘুড়ি ওড়ানো ছেলেদের হাত থেকে সুতো কাটা ঘুড়িরা এসে; গাছের সাথে জড়িয়ে পড়ে পত পত করে উড়ে চলেছে৷ দক্ষিণ দিকে আকাশ প্রচুর৷ খুলনা আলিয়া মাদ্রাসা প্রাঙ্গণে অর্কিড রঙের আল্পনা আঁকা মডেল মসজিদের গম্বুজ আর পিলারগুলো রাতের বেলায় রেডিয়াম বিচ্চুরণ করে ভারি সুন্দর আলো ছড়ায়!

নৈঋতে রয়েছে একটি বই রাখার র‍্যাক৷ গরীবের ঘোড়া রোগের ন্যায় অল্প জানা মানুষ হয়েও; আমারও কিন্তু বই পড়া আর সংগ্রহ করার বাতিক রয়েছে৷ এটা কোনো বিলাসীতা নয়৷ জানার তেষ্টায় গলা ভেজানোর অন্যুন ব্যবস্থা৷ বহুদূর থেকে ছুড়ে মারা তীর যেমন পতিত স্থানে গিয়ে ৯০ ডিগ্রি কোণ এঁকে গেঁথে পড়ে৷ এভাবে এপাশ-ওপাশ নিয়মিত দূরত্বে গেঁথে থাকা তীরের মত ডিজাইন এই বইয়ের র‍্যাকটি৷ সেখানে ছায়া সুনিবিড় গাছের শাখায় বিশ্রামরত পাখিদের ন্যায় গোর্কি, হিটলার, মারিও পুজো, ভল্টেয়ারের সাথে নির্বিবাদে পাশাপাশি শুয়ে আছে রবীন্দ্র-নজরুলসহ আরো অনেকেই। উপর-নিচে জাকির নায়েক, আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর, ইমাম গাজ্জালীরা ওদের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে মুগ্ধ ভীষণ৷ আর সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই এর মত উপরের তাকে পবিত্র গ্রন্থ৷

এখন খাটের উপর পশ্চিমমুখে কাত হয়ে শুয়ে আছি আমি- বইয়ের র‍্যাকের একটি তাকে ‘স্পিরিট অব ইসলাম, ক্রিটিক অব রিজন, তুজুক-ই বাবরী এবং লা নুই বেঙ্গলির প্রচ্ছদ দেখতে পাচ্ছি৷ একপাশে মহাদেব সাহার ধুলোমাটির মানুষের গায়ে ছত্রাক জমে আছে৷ নতুন করে ওটাকে একটু নেড়ে-চেড়ে দেখার দরকার৷

পশ্চিম দিকের দেয়ালের ওপাশে আরেকটি রুম৷ বায়ুতে একটি দরজা আছে শোবার ঘরে। এখান দিয়েই বসার ঘর, খাবার ঘর আর গবেষণাগারে ডেসপাচ-এ্যারাইভ করি আমি। ঈশান কোণে মেঘ জমিয়ে ভয় দেখানোর কিচ্ছুই নেই। ওটা একটি নিরেট দেয়াল উত্তর-পূবের৷ উপরে একটি সিলিং ফ্যান সারাবছর তার ঘুর্ণন প্রক্রিয়া সম্পাদন করে যাচ্ছে শীত মৌসুমে পূর্ণ বিশ্রামে যাবার আশায়৷ নিচের দিকে খাট আর ফ্লোর, সেই খাটের উপর শুয়ে শুয়ে আমি আমার শোবার ঘরের ঈশান-বায়ু, অগ্নি-নৈঋত এর গল্প শুনালাম৷

আসলে ৩৬০ ডিগ্রির আমাদের এই পৃথিবীতে ৯০ ডিগ্রি সমভাগের সমান্তরাল ৪টি দিকসহ ৪৫ ডিগ্রির আরো ৪টি কৌণিক দিক রয়েছে৷ সেইসাথে সুমেরু-কুমেরু বিন্দুর ন্যায় উপর-নিচ মিলে আমাদের পৃথিবীর ১০ দিক বুঝায়৷ কৌণিক দিকগুলিকে ঈশান-বায়ু, অগ্নি-নৈঋত বলে৷

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *