মিলন হোসেন নিবিড়,নালিতাবাড়ী উপজেলা প্রতিনিধিঃ (শেরপুর)
বয়স থাকতে একটা দোকান চালাইতাম। দোকানে লোকসান খাইয়া পরে একটা রিকসা ভাড়া নিয়া চালাইলাম। এরপর ডায়াবেটিস হাসপাতালে সিকিউরিটি গার্ড হিসাবে চাকরী পাইয়া কোন মতে চলতাছিনাম। কিন্ত চাকরীটা চইলা যাওয়ার পর আবার রিকসা চালাইবার লাইগা চইলা গেলাম ঢাকা । কিন্ত বয়স ও অসুখের কারণে ঢাকা থাকবার না পাইয়া আবার বাড়ীতে আইলাম। অসুখের লাইগা অহনা আর রিকসা চালাইবার পাই না। ঘরে শুধু আজকের খাওন আছে। কাইলকা কী খামু আল্লাই জানে। নিজের জমি নাই শ^শুরের বাড়ীতে থাকতাছি। কথাগুলো বলছিলেন শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলার বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ কারী মো.আবদুল হাই(৬৫)।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যার পর দেশে বিভীষিকাময় পরিস্থিতি তৈরি হয়। স্তম্ভিত হয়ে পড়েছিল গোটা দেশ। থেমে গিয়েছিল অনেকেই। কিন্তু থামেনি এক দল মুক্তিযোদ্ধা, তরুণ, ছাত্র, কৃষক, শ্রমিকসহ মুজিবপ্রেমিক। তৎকালীন সামরিক সরকার মিছিল-মিটিং সব বন্ধ করে দেয়। তখন বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে জাতীয় মুক্তি বাহিনী ও চট্টগ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রয়াত এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর নেতৃত্বে জাতীয় মুজিব বাহিনী নামে দুটি সশস্ত্র প্রতিরোধ বাহিনী গঠিত হয়। কয়েক হাজার বঙ্গবন্ধু ভক্ত ছাত্র-তরুণ-যুবক এ দুই বাহিনীতে যোগদান করেন। তারা ক্ষমতাসীন খুনীচক্রর বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহে লিপ্ত ছিলেন। বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর ডাকে সে দিন শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলার প্রায় তিনশত যুবক বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে উপজেলার চৌকিদার টিলা, হালুয়াঘাটের গোবড়াকুড়া ও পরে ভারত সীমানার চান্দুভুঁই এলাকায় ক্যাম্প স্থাপন করে বঙ্গবন্ধুর খুনি চক্রের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলে। ২২ মাস মাইনকারচর থেকে সুনামগঞ্জের তাহিরপুর পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকায় তাদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে । এসব যোদ্ধার অনেকেই যুদ্ধ ক্ষেত্রে মারা গেছেন, কেউ ধরা পড়ে অমানবিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত মেলেনি তাদের আত্মপরিচয়। তাদের দাবি দুর্বিষহ জীবনের কষ্ট লাঘবে স্বীকৃতি ও চিকিৎসা সহায়তা প্রদানের।
স্থানীয় প্রতিরোধ যোদ্ধারা জানান, ’৭৫-এর ১৫ আগস্টের পর বঙ্গবন্ধুর খুনি চক্রের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিতে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী হালুয়াঘাটের গোবড়াকুড়ায় কয়েক দিন অবস্থানের পর চলে আসেন উপজেলার নয়াবিল ইউনিয়নের চৌকিদার টিলায় (বর্তমানে এখানে বিজিবি ক্যাম্প)। তখন এর নাম ছিল বেদেরকোণা। এখানে কাদের সিদ্দিকীর নের্তৃত্বে সাড়ে ৩০০ যুবক অস্ত্র প্রশিক্ষণ নেয়। বারোমারি মিশন পর্যন্ত গড়ে তোলা হয় প্রতিরক্ষা ব্যুহ। তবে চার মাস পরেই সেনাবাহিনী, বিডিআর বাহিনী সাঁড়াশি আক্রমণে নামে। বেঁধে যায় প্রবল যুদ্ধ। টানা চার দিন যুদ্ধের পর ভারি অস্ত্রশস্ত্রের কাছে টিকতে না পেরে প্রতিরোধ যোদ্ধারা পেছনে সরে ভারত সীমানার চান্দুভুঁই এলাকায় ক্যাম্প স্থানান্তর করে। পরে এখানেই হেড কোয়ার্টার স্থাপন করে কাদের সিদ্দিকীর নির্দেশে প্রতিরোধ যোদ্ধাদের নামকরণ করা হয় ‘জাতীয় মুক্তি বাহিনী। ১৯৭৬ সালের ১৫ আগস্টকে জাতীয় শোক দিবস ঘোষণা করে নতুন পরিকল্পনা করে কাজ শুরু করে জাতীয় মুক্তি বাহিনী। এ সময় তারা মাইনকারচর থেকে সুনামগঞ্জের তাহিরপুর পর্যন্ত বিস্তীর্ণ পাহাড়ি এলাকাকে ৩৬টি কোম্পানিতে বিভক্ত করে ৪টি সাব-হেডকোয়ার্টার স্থাপন করে। এগুলো হল- ডোমনা, রংরা, বাঘমারা ও গোবড়াকুড়া। এ সময় তারা কিছু সময়ের জন্য দুর্গাপুর, কলমাকান্দা থানা, ডুমনি, বান্দরঘাটাসহ বেশ কয়েকটি বিওপি দখলে নিয়ে জামালপুরের কামারের চর, নরুন্দি রেল স্টেশনসহ বিভিন্ন এলাকায় হামলা চালায়। তবে ১৯৭৭ সালে ভারতে কংগ্রেস সরকারের পতনের পর জাতীয় মুক্তি বাহিনীর সদস্যদের দেশে ফিরিয়ে দেয়ার মাধ্যমে সমাপ্ত হয় এ প্রতিরোধ যুদ্ধ। শুরু হয় বাহিনীর সদস্যদের কঠিন জীবন। কাউকে নরুন্দি বন্দি ক্যাম্প, ময়মনসিংহ বিডিআর ক্যাম্প, কলাকুপা বান্দুরা ক্যাম্পসহ বিশেষ বন্দিশালায় রেখে নানা রকম ইন্টারগেশন ও টর্চার করে ছেড়ে দেয়া হয়। আবার কাউকে কাউকে সাজা দিয়ে পাঠানো হয় জেলখানায়। ১৯৯৬ সালে জাতির জনকের কন্যা শেখ হাসিনার ইচ্ছায় জাতীয় মুক্তি বাহিনীর নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় প্রতিরোধ যোদ্ধা পরিষদ। ১৯৯৬ সালের ১২ আগস্ট নালিতাবাড়ী উপজেলার প্রতিরোধ যোদ্ধারা ঢাকা শেখহাসিনার সাথে সাক্ষাত শেষে বাড়ী ফেরার পথে সড়ক দুর্ঘটনায় একটি মাইক্রোবাসে দশ জনের মধ্যে চার জন প্রতিরোধ যোদ্ধা সহ ছয়জন মারা যান। নালিতাবাড়ী উপজেলার প্রায় তিনশত জন প্রতিরোধ যোদ্ধার মধ্যে বর্তমানে বেঁচে আছেন ১৫০ জনের মত। সকলেরই বয়স এখন ৬০ থেকে ৭০ মধ্যে। বেশীর ভাগ যোদ্ধারা রোগে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা করতে না পেরে জীবন চলছে চরম দুর্বিসহ। কেউ কেউ রিকসা চালিয়ে জীবন চালালেও বয়সের কারণে এখন তাও করতে পারছেনা। এক বেলা খেলে পরের বেলা খাবারের দুশ্চিন্তায় থাকে।
নালিতাবাড়ী উপজেলা প্রতিরোধ যোদ্ধা কমিটির সভাপতি মো.ফজল হক বলেন,আমাদের চেয়ে আপন শেখ হাসিনার আর কে আছে ? বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে আমরা জীবনের ঝুকি নিয়ে যুদ্ধ করি,জেল খাটি। এখন আমরা নিদারুন কষ্টে দিন যাপন করছি। অনেকেই খেয়ে না খেয়ে দিন যাপন করছে। আমরা চাই আমাদের বোন প্রধান মন্ত্রী আমাদের একটু দেখবে ,সম্মান দিবে স্বীকৃতি দিয়ে।