আলু বিক্রিতে লোকশানে জয়পুরহাটের খুচরা ব্যবসায়ীরা

মোঃ সারোয়ার হোসেন অপু

স্টাফ রিপোর্টারঃ

সরকারের বেঁধে দেওয়া দামে আলু বিক্রিতে লোকসান গুনতে হচ্ছে খুচরা ব্যাবসায়ীদের ফলে আলু উৎপাদনে উদ্বৃত্ত জেলা জয়পুরহাটের বাজার এখন প্রায় আলু শূণ্য হয়ে পড়েছে। এতে বেকায়দায় পড়েছেন ভোক্তা সাধারণ।

আলু উৎপাদনে দেশের বৃহত্তম জেলা হিসেবে খ্যাত জয়পুরহাট। এ বছর আলু চাহিদার তুলনায় উৎপাদনও হয়েছে অনেক বেশী। যা লক্ষমাত্রার চেয়ে প্রায় দেড়গুন অতিরিক্ত। সেই ভান্ডারে হঠাৎ করে আলুর বাজার উর্দ্ধগতি। এসময় সরকারের বেঁধে দেওয়া দামে বাজারে অভিযানে নামে ভ্রাম্যমান আদালত। আর অভিযানের ভয়ে বাজারে আলু বিক্রি বন্ধের কথা বলছেন ব্যবসায়ীরা।

খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন হিমাগারে আলুর মজুদ থাকা সত্বেও সরকারের বেঁধে দেওয়া দামের চেয়ে বেশি দামে কিনতে হচ্ছে আলু। তাই বেশি দামে কিনে কম দামে বিক্রি করলে লোকসানে পড়ছেন তারা। এমন পরিস্থিতি অভিযানে নেমেছে প্রশাসন। তাই বাধ্য হয়ে আলু বিক্রি বন্ধ রেখেছেন এমন মন্তব্য খুচরা ব্যবসায়ীদের । গত ১৭ সেপ্টেম্বর সরকারের বেঁধে দেওয়া দামের চেয়ে আলু বেশি দামে বিক্রির অভিযোগে কালাই উপজেলার আর বি হিমাগারের তিন আলু ব্যবসায়ীকে জরিমানা করে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। ওই অভিযানের পর সকল হিমাগার থেকে আলু সরবরাহ কমিয়ে দেন ব্যবসায়ীরা। এতে বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি হয়।

জয়পুরহাট শহরের মাছুয়া বাজার নতুনহাট ও পূর্ব বাজার ঘুরে দেখা গেছে, সরকারের বেঁধে দেওয়া দাম নয়, বরং তার চেয়ে বেশি দামে আলু বিক্রি হচ্ছে। জাম আলু বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৬০ টাকা থেকে ৬৫ টাকা, স্টিক ৪০ টাকা থেকে ৪৫ টাকা, ভান্ডারপুর ৫৫ টাকা, ফাটা পাকরি ৫০ টাকা । আলু হিমাগারে রাখার সময় প্রকারভেদে দাম পড়েছিল ১০-১৫ টাকা কেজি। হিমাগার থেকে বের করার সময় সব খরচ বাদে ওই আলুর দাম পড়বে ১৭-২২ টাকা কেজি।

সরকারের বেঁধে দেওয়া পাইকারি দাম ২৬-২৭ টাকা কেজি এবং খুচরায় ৩৫-৩৬ টাকা কেজি। এই দামে আলু বিক্রি করলে মজুতদার ও খুচরা পর্যায়ে লাভ থাকবে। কিন্তু সিন্ডিকেট করে ৪০-৬৫ টাকা কেজি দরে আলু বিক্রি করা হচ্ছে। জানতে চাইলে জেলা শহরের মাছুয়া বাজারের খুচরা সবজি ব্যবসায়ী আব্দুর জোব্বার বলেন, আলুর কেনা দামই বেশি। তাহলে আমাদের তো বেশি দামে বেচতে হবেই। কেনা দাম বেশি হলে কম দামে কীভাবে বিক্রি করবো? আমার দোকানে জাম আলু, স্টিক, ফাটা পাকরি ও ভান্ডারপুর জাত মিলে তিন মণের মতো আলু আছে। এগুলো বিক্রি শেষ হলে দাম সঠিক মতো না আসলে আর বিক্রি করবো না।

জয়পুরহাট জেলা শহরের পূর্ব বাজারে কোনো সবজির দোকানে আলু পাওয়া যায়নি। সেখানকার সবজি ব্যবসায়ী বিরেন মহন্ত বলেন, প্রকারভেদে প্রতি কেজি আলু ৪০ টাকা থেকে ৪৫ টাকা দরে পাইকারিতে কিনতে হচ্ছে। তাহলে খুচরায় আমরা কত টাকায় বিক্রি করবো? এর মধ্যে পরিবহন খরচ, পলিথিন, শ্রমের দাম আছে। তারপরও আলু নাকি ৩৬ টাকা থেকে ৩৭ টাকা কেজিতে বিক্রি করতে হবে। আমরা এই দামে আলু কিনতেই পারছি না। তাহলে বেচবো কত টাকায়? এজন্য আলু বিক্রি বন্ধ করে দিয়েছি। আমাদের এই বাজারের কোনো সবজি ব্যবসায়ীর দোকানে আলু নেই।

সরেজমিনে কয়েকটি হিমাগার ঘুরে দেখা গেছে, হিমাগারগুলোর শেডে আলু নেই। কোনটির শেডে আলু থাকলেও সেগুলো বিক্রি করা হচ্ছে না। ওই আলু অন্যত্র মজুতের জন্য সরানো হচ্ছে। উত্তরের সীমান্ত ঘেঁষা কৃষি নির্ভর জেলা জয়পুরহাট। এখানে মোট কৃষি জমির প্রায় ৬০ ভাগ জমিতেই আলু চাষ করেন চাষীরা। বরাবরই কৃষকরা তেমন লাভের মুখ দেখেন না।

এ বছর হিমাগারে আলু সংরক্ষণকালে ১৮/২০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করে। সেই আলু কয়েক মাসের ব্যবধানে ৫৫ টাকা কেজিতে দাড়িয়েছে। জেলায় ১৯টি হিমাগারে সংরক্ষণের এখনও ৫০ ভাগ আলু মজুদ থাকলেও আলুর কৃত্রিম সংকট তৈরী করে দিগুন দামে বিক্রি হচ্ছে খুচরা বাজারে। এতে প্রান্তিক কৃষক ও ভোক্তারা সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি। এ সময় সরকার বেঁধে দিয়েছে আলু, পেঁয়াজ ও ডিমের দাম। তবে ডিমের দাম কমলেও অধিক দামে বিক্রি হচ্ছে পেঁয়াজ। আর অভিযানের ভয়ে ব্যবসায়ীরা বন্ধ রেখেছেন আলু বিক্রি।

এতে ভোগান্তিতে পড়ছেন সাধারণ ভোক্তারা। খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, হিমাগার ও পেঁয়াজের বাজার নিয়ন্ত্রণ করেন বড় বড় মজুদকারীরা। আলু মজুদ থাকা সত্বেও সরকারের বেঁধে দেওয়া দামের চেয়ে বেশী দামে কিনতে হচ্ছে তাদের। এরপর অভিযানে নেমে বিনা অপরাধে জরিমানা গুনতে হচ্ছে খুচরা ব্যাবসায়ীদের । জেলা পূর্ব বাজারের আলু ব্যবসায়ী রশিদ বলেন, সিন্ডিকেটের কারণে খুচরা ব্যবসায়ীদের বেশী দামে ( সাড়ে ৩৭ টাকা কেজি) আলু কিনতে হচ্ছে। পরিবহন খরচ দিয়ে কিনতে প্রায় ৩৯/৪০ টাকা পড়ে যাচ্ছে। সেই আলু সরকারের বেঁধে দেওয়া দামে (৩৫/৩৬ টাকা) বিক্রি করলে কেজি প্রতি ৩/৪ টাকা লোকসান হচ্ছে। মূলত এ কারণে আলু বিক্রিতে অনিহা খুচরা ব্যাবসায়ীদের। আর মজুদদারা বলছেন, যে সময় আলুর বাজার কমে যায়, তখন কারও নজরে আসেনা।

এবছর একটু দাম বেশী থাকায় বিগত বছরের ক্ষতি পুষিয়ে নিচ্ছেন এমন মন্তব্য তাদের । হিমাগারগুলোতে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সংরক্ষণের প্রায় ৪৫ ভাগ আলু এখনও মজুদ আছে। তবে আলু সংরক্ষণকারীরা হিমাগার থেকে চাহিদামত আলু উত্তোলন না করায় খুচরা বাজারে আলুর মুল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে জানান, গোপিনাথপুর হিমাগারের হিসাব রক্ষক রবিউল ইসলাম। সিন্ডিকেট রোধে মাঠে কাজ করছেন বলে বরাবরের মত আশার বাণী শোনালেন বাজার নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব পালনকারী জেলা কৃষি বিপণন কর্মকর্তা রতন কুমার রায়। জয়পুরহাটসহ বিভিন্ন জেলার আলুর চাহিদা মিটিয়ে থাকে এখানকার আলু।

এ বছর জেলায় ৯ লাখ ২৩ হাজার ২ শ’ মেট্রিক টন উৎপাদন হয়েছে । স্থানীয় পর্যায়ে ভোক্তা চাহিদা হচ্ছে ৪০ হাজার মেট্রিকটন আলু। হিমাগারে মজুদ রয়েছে এখনও প্রায় ৮০ হাজার মেট্রিকটন আলু । এরপরও বাজারে আলুর কৃত্রিম সংকটকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ রাহেলা পারভিন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *